চুপকথা রা | বাংলা সাহিত্য চুপকথা রা – বাংলা সাহিত্য
চুপকথা রা

চুপকথা রামামার বাড়িটাই আমার রহস্যময় লাগত। প্রতিবার গিয়ে সে রহস্যময়তা উন্মোচন করতে চাইতাম। এক বাড়ির গঠনে সমতা থাকলেও ঘরগুলো আমাদের আটঘরিয়ার বাড়ির মত নয়। মাটির ঘর কিন্ত অনেক স্ফীত চেহারার। মাটির উঁচু উঁচু খান তিনেক সিঁড়ি ভেঙ্গে চওড়া বারান্দা। তিনদিকে বারান্দার বেস্টনীতে ঘেরা ঘর ছিল দাদু দিদিমার। ওই ঘরে আমরা কদিন ডেরা বাঁধতাম। দিদিমার বিছানাতে দিনভর গড়াগড়ি যেতাম। খুব ভালো একটা গন্ধ পেতাম দিদিমার বিছানায়। পান জর্দার গন্ধ। দোক্তা ও ছিল। আমার ঠাকুমা জর্দা খেত না। শুধুই হাতে করা দোক্তা। সে ঘরে খেজুর কাঁড়ির সাঙা মানে উঁচু তাক করা ছিল। বিছানা বালিশের ঢের যত্নে ঢেকে রাখা থাকত। বাড়ীতে অনেক অতিথি এলেও অসুবিধা হত না। আমার সবচেয়ে কৌতূহলজনক মনে হত বারান্দা গুলো। অনেকটা চওড়া আর বাঁশের ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা। সামনের বারান্দায় দাদুর বিছানা আর সে বিছানায় যে কত রকমের আকর্ষণ। সবচেয়ে টানত বাতাসার কৌটো। দাদু বাথরুমে গেলে চুরি করে নেব বলে যেই না ঢাকনা খুলতাম, দাদু বলত,”আমি সব থুতু মাখিয়ে রেখে এসেছি। ” এসব ছাড়া আমি নেশাগ্রস্তের মত ঘেরা বারান্দা হাতড়ে যেতাম। দুটো বোধহয় ফুট ছয়েক লম্বা জালা ছিল। সেগুলো বাড়িতেই বানানো। তাতে নাকি ডাল,গম থাকত।বাইরের মরাইয়ে ধান। আমি যতবার বড়সড় বোতলসদৃশ জালাগুলো দেখতাম আমার এতটুকু ছাতিতে বড়সড় ছলাৎ ঢেউ উঠত। আলিবাবার ডাকাতসর্দারের জালাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠত। এর মাঝে প্রায়বৃদ্ধ সকালে সাইকেলে প্যাঁকপ্যাঁক করে আজহার মামা। সে মানুষটিকে প্রথম যখন দেখি কি ভয়ই পেয়েছিলাম। কুচকুচে কালো বদনে সাদা দাড়ি সাদা চুল আর হলদেটে দাঁতে হেসে ডাক দিত। তার ট্যারা চোখ দেখে প্রথমে সাইকেলের পেছনে বাঁধা টিনের বাক্সটা খেয়াল করিনি। পরে তপনদা মানে বড়মামার ছেলে বোঝাল যে ওটা শোনপাপড়ির বাক্স। দশ পয়সায় এতটা। এর পরে আজহার মামা এলেই আমি ছুটে ছোড়দিদিমার কাছে দশ পয়সার জন্য। ছোড়দিদিমা কপট বিরক্তি নিয়ে তোরঙ্গের ডালা খুলতে খুলতে বলত, “ঐ বুড়ু মানুষের চুল কি সুখে খাস লো ছুঁড়ি?” তারপর একদিন দেখি আজহার মামার সাইকেলের পেছনে সে বাক্স নেই। একটা লম্বা টিন কাতা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। আমাকে দেখে নীচের রাস্তা থেকে চেঁচিয়ে বলল, “নীলুর বেটি, খেজুর গুড় এনেচি। বলো ভালো সার গুড়।” তারপর লম্বা চ্যাপটা আঁকশি দিয়ে টিনের মধ্যে থেকে তুলে দেখাতে লাগল। আমাদের বাড়িতে ও দাদুর কখানা খেজুর গাছ ছিল। কাঙলুকাকা সে গাছ করত। জিরেন কাঠের রস মাঝেমাঝেই খাওয়াত। আর পৌষপার্বণে ঝোলা গুড় দিয়ে যেত। পাটালি আসত বাজার থেকে। কিন্তু আখের গুড়ের মত খেজুর গুড় আগে দেখিনি, খাওয়া দূরের কথা। আর যে স্যাকরাবাড়ির কথা বলেছিলাম তার থেকে বেশ অনেকটা ওপরে ছোড়দাদুর লম্বা গোয়ালঘর। তো সেদিন হোল কি পচাদাদুর সাতসকালে গান পেয়ে গেল। গানের চরণ ছিল “কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব…”। এখন হোল কি মাধবীমাসী ছিল কাজের মুডে। সে গোয়ালঘরে কিছু একটা করছিল। গোয়ালঘর ও তো এক স্টোররুম ই ছিলো। হোল কি পচাদাদুর গান কানে আসতেই মাধবীমাসি উদাত্ত গলায় গান ধরল পাদপূরণ করতে–” পচাকে দিয়ে যাও,পচাকে দিয়ে যাও–পচার তো বউ নেই —- আর দুটো যদি বেশি থাকে খগেনকেও দিও”। একই কীর্তনীয়া সুর কিন্তু তাতে পচাদাদু বিনা প্রতিবাদে শখের গান গাওয়া থামিয়ে দিল। কে না জানে মাদুবী বড্ড ঠোঁটকাটা তার ওপরে রায়েদের মেয়ে। বললে নিশ্চয়ই হাউহাউ করে উঠবে ” কেন তোমার মা কি একা ছেলের নাম পচা রেখেছে নাকি?”অনামা একটা গাঁয়ের কথা এক কে না কে বকে বকে বলবে তা সময় নিয়ে পড়া ও তো কষ্টকর। কাল থেকে বরং অন্য কিছু লিখব। কি লিখি বলুন তো? আমার যে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে।


kingshook